ত্রিপুরায় ভারী বর্ষণের কারণে বন্যা হওয়ার পর ডুমুর বাঁধের দ্বারোন্মোচন করেছে ভারত। ১৯৯৩ সালে প্রথম বাঁধ খুলে দেওয়ার ৩১ বছর পর দ্বিতীয়বারের মতো সকল গেট খুলে দেওয়া হয়েছে। এরপর থেকেই বাংলাদেশের কুমিল্লা, ফেনী, নোয়াখালী, মৌলভীবাজার, খাগড়াছড়িসহ ৮টি জেলা ভয়াবহ বন্যা কবলিত হয়।
এরপর থেকেই আলোচনায় উঠে আসে বাংলাদেশের প্রতি ভারতের পানি আগ্রাসন। বাংলাদেশ-ভারতের সীমান্তের কাছাকাছি প্রায় সকল নদী এবং শাখা নদীর উজানে বাঁধ দিয়েছে ভারত। ভারত বাংলাদেশের উজানে হওয়ার কারণে বাংলাদেশের সবচেয়ে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে এইসব বাঁধের জন্য।”শুষ্ক মৌসুমে নদীর নাব্যতা কেড়ে নিয়ে বর্ষায় বন্যা উপহার দেওয়া কোনমতেই প্রতিবেশী দেশ থেকে কাম্য নয়” -এমন মন্তব্য বাংলাদেশের নাগরিক সমাজের।এই প্রতিবেদনে আমরা ত্রিপুরার ডুম্বর হ্রদ এবং তার উপর স্থাপিত বাঁধের কার্যকারিতা নিয়ে জানার চেষ্টা করবো।
ডুম্বুর হ্রদ:
হিন্দু ধর্মের ভগবান শিবের ডাম্বু থেকে অপভ্রংশের মাধ্যমে ডুম্বুর নামটি এসেছে। ডুম্বুর তীর্থস্থান হিসেবে হিন্দুধর্মাবলম্বীদের কাছে বেশ শ্রদ্ধার জায়গা।ডুম্বুর হৃদ বাংলাদেশের সীমান্ত থেকে প্রায় ১২০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আমবাসা থেকে প্রায় ৭০ কিলোমিটার দূরে গন্ডতউইসা সাব-ডিভিশনে এটি অবস্থিত। এর আয়তন ৪১ বর্গ কিলোমিটার এবং এই হৃদে মোট ৪৮টি দ্বীপ রয়েছে।
এই দ্বীপকুঞ্জকে স্থানীয়ভাবে “নারকেলকুঞ্জ” বলে ডাকা হয়। হ্রদটি রাইমা ও সইমা (সারমা) নদীর সঙ্গমস্থল আর এর উপত্যকায় গোমতি নদী যা পরবর্তীতে কুমিল্লা হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। ১৯৭৪ সালে বর্তমান ডুম্বুর হ্রদ থেকে তিন কিলোমিটার দূরে এই বাঁধটি নির্মিত হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিলো জলবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা। কিন্তু অভিযোগ ওঠে যে তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল কংগ্রেস রাইমা উপত্যকার আদিবাসীদের সম্পর্কে বাস্তবতা এবং ফলাফলের কোনো হিসাব না করেই উর্বর জমিতে জলবিদ্যুৎকেন্দ্রটি স্থাপন করে।
বাঁধের কারণে ২৭ হাজার আদিবাসীরা তাদের ঘরবাড়ি হারায় এবং তাদের সব জমি পানির নিচে তলিয়ে যায়।৪৪টি দ্বীপসহ মনোরম ডুম্বুর হ্রদটি একসময় ১২ হাজার পরিবার এবং ২৭ হাজার আদিবাসী টিপরাসা কৃষকদের উর্বর শস্যভূমি ছিল যা বাঁধ স্থাপনের জন্য অধিগ্রহণ করা হয়। ডুম্বুর জলবিদ্যুৎ প্রকল্পটি ১৯৭৬ সালে চালু করা হয়েছিল। এর দুটি ইউনিটের ১০ মেগাওয়াট উৎপাদন করার ক্ষমতা রয়েছে।
১৯৮৪ সালে স্ট্যান্ডবাই হিসাবে পাঁচ মেগাওয়াটের একটি তৃতীয় ইউনিট নির্মাণ করা হয়েছিল।ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের ২২ আগষ্টের এক বিবৃতি মোতাবেক এটি একটি স্বল্প উচ্চতাবিশিষ্ট (প্রায় ৩০ মিটার) বাঁধ যা বিদ্যুৎ উৎপন্ন করে একটি গ্রিডে পাঠায় এবং সেখান থেকে বাংলাদেশ ও ত্রিপুরা থেকে ৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎশক্তি গ্রহণ করে।কিন্তু টেলিগ্রাফ ইন্ডিয়ার সূত্র মোতাবেক গত পাঁচ বছরে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পটি প্রত্যাশিত মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে ব্যর্থ হয়েছে। হ্রদের ভারী পলির কারণে আশেপাশের দুটি পাহাড়ি শ্রেণি থেকে ব্যাপক মাটি ক্ষয়ের কারণে প্রচুর পরিমাণে বন উজাড় হয়েছে। এছাড়াও প্রতি বছর দীর্ঘ শুষ্ক মৌসুমে প্রকল্পটি বন্ধ হয়ে যায়। কারণ হ্রদের পানির স্তর কমে যায় এবং টারবাইনগুলো বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য পর্যাপ্ত পানি পায় না। এ কারণে কাঙ্খিত মাত্রায় বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যহত হয়। এ কারণে প্রশ্ন থেকেই যায় এই বাঁধটি যুক্তিযুক্ত নাকি বাংলাদেশকে পানিশাসন করার ভারতের একটি প্রয়াস। এই প্রশ্ন বাংলাদেশের সচেতন সমাজের।
এই প্রেক্ষিতে ভারতের পক্ষ থেকে যা শোনা যাচ্ছে: ২০২৪ এর আগষ্টের মধ্য সপ্তাহ থেকে অতিবৃষ্টিপাতের ফলে হাওড়া, খোয়াই, মুহুরী ও ঢলাইসহ রাজ্যের প্রায় সব নদীই বিপদসীমার ওপর দিয়ে বইছে। গত ৪০ বছরে সর্বাধিক বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে বলে জানান ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী মানিক সাহা। তিনি আরও উল্লেখ করেন এমন পরিস্থিতিতে ত্রিপুরার ডুম্বুর হাইড্রোইলেক্ট্রিক পাওয়ার প্রজেক্ট এর গেট খুলে দেওয়া হয়েছে।গোমতী জেলার জেলা শাসক তরিৎ কান্তি চাকমা তার সরকারি এক্স (সাবেক টুইটার) হ্যান্ডেলে জানিয়েছেন যে, গোমতী নদীতে পানিস্তর বেড়ে যাওয়ার ফলে ডুম্বুর জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের বাঁধের পানিস্তরও বিপৎসীমা ছুঁয়ে ফেলেছিল। বাঁধ বাঁচাতে গেট খুলে পানি ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে।